শাকুর মাহমুদ চৌধুরী, কক্সবাজার
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা দিনে দিনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যা স্থানীয়দের জন্য একটি চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে। গত সাত বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৪,০০০ মামলা দায়ের হয়েছে এবং আসামির সংখ্যা ৯,০০০ ছাড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সতর্ক থাকলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধের বিস্তার স্থানীয়দের মধ্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা, মানবেতর জীবনযাপন এবং হতাশার ফলে অনেক রোহিঙ্গা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয়দের মতে, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচার, মানব পাচারসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় এলাকাগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করছে। মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, এবং এমনকি খুনের মতো গুরুতর অপরাধ ক্যাম্প থেকে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিগত সাত বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি, এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে।
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “আমরা সবসময় সতর্ক আছি এবং অপরাধ দমনে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। তবে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সংঘটিত অপরাধগুলো দমন করতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে তারা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। টেকনাফের একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও চুরি, ডাকাতির খবর আসছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা আমাদের গ্রামেও এসে অপরাধ করছে। এমন চলতে থাকলে আমরা এখানে আর নিরাপদ নই।
অনেক স্থানীয় বাসিন্দা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের হতাশা এবং দারিদ্র্য তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হতে পারে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিলম্ব এবং ক্যাম্পে বসবাসরতদের মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব তাদের এ ধরণের অপরাধে প্রলুব্ধ করছে।
স্থানীয় বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের অপরাধ এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ক্যাম্পের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো সংগঠিত হয়ে আরও বড় ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
উখিয়ার এক স্থানীয় প্রবীণ মুরুব্বি ওসমান গনি বলেন, যদি এই অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে শুধু স্থানীয়রাই নয়, পুরো কক্সবাজার জেলার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এমনকি এই প্রভাব দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগে দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা এবং ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম আরও জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবিকার জন্য উন্নত কর্মসূচি গ্রহণ করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
স্থায়ী সমাধান না হলে উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘমেয়াদে চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে পারে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অপরাধ বৃদ্ধির ফলে উখিয়া এবং টেকনাফের স্থানীয়রা বর্তমানে একটি মারাত্মক নিরাপত্তা হীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। প্রশাসনের আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু না হলে, এই সংকট কেবল স্থানীয় নয়, দেশের জন্যও একটি বড় হুমকিতে পরিণত হতে পারে।
Leave a Reply